'আমি মুক্তি চাই অভ্র!'
'দেখ সুপ্রিয়া, আমি তো রুদ্র না যে বলব,
মুক্তি নিবি ?
চল তোকে আজ মুক্তি দিলাম!
একা একা তুই যখনই দেখবি আকাশ,
দেখবি মেয়ে আমিই তোর আকাশ ছিলাম!
আমি হলাম অভ্র। আর আমি তোমাকে কিছুতেই মুক্তি দেব না।'
'তবে আমি নিজেই ডিভোর্স দেব।'
'আমি আইনি লড়াই করতে প্রস্তুত।'
'তুমি এতটা নিচ তা আগে জানা ছিল না।'
'এখন ভালো করে জেনে নাও।'
'অসহ্য'
'তুমি তো অপূর্ব!'
সুপ্রিয়া আর কথা বাড়ায় না। এই লোকটার সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তার পরেও যার সাথে একই ছাদের নিচে, একই ঘরের ভিতরে একই বেড শেয়ার করতে হয়। তার সাথে কথা না বলেও থাকা যায় না। অভ্র অনেকটা জোর করেই এই বিবাহিত সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে। এবং এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে যেন সম্পর্কটা না ভাঙ্গে।
-
অভ্র আর সুপ্রিয়ার পরিচয় আজ থেকে চার বছর আগে। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে অভ্রকে দেখে সুপ্রিয়াই প্রথমে নিজে থেকে কথা বলতে গিয়েছিল। সেই থেকেই দুজনার পরিচয়। প্রথম দিকে সুপ্রিয়াই বেশি ইন্টারেস্টেড ছিল অভ্রের প্রতি। অভ্রের আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি, কথা বার্তা সবকিছুই যেন সুপ্রিয়াকে চৌম্বকের মত আকর্ষণ করেছিল। সে অনেকবার অভ্রের থেকে নিজেকে দমানোর চেষ্টা করেও পারে নি। শেষমেশ অভ্রের প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা একসময় বলেই দেয় সে। তখন সুপ্রিয়ার মনে হত, অভ্রকে না পেলে তার পুরো মানবজনমই বৃথা!
সুপ্রিয়ার প্রতি অভ্রের প্রেম-ভালবাসাটা সুপ্রিয়ার মত হুট করেই তৈরি হয় নি। মেয়েটার মাথার লম্বা চুল, সুন্দর মুখাবয়ব, টানা চোখ, ছিপ ছাপ গড়ণের দেহ, সুন্দর কণ্ঠস্বর বা গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলার ধরণ যে অভ্রকে আকর্ষিত করে নি তা না। তবে অভ্র ঠিক এসবের মোহে পড়েও সুপ্রিয়ার প্রেমে পড়ে নি। সে প্রেমে পড়েছে আস্তে ধীরে। কাজেই সুপ্রিয়ার প্রতি তার প্রেমটা একটু বেশিই বলা চলে। অভ্রের প্রেমের ভীত শক্ত। সে মনে মনে শপথ করে নিয়েছে, সুপ্রিয়াকে আমৃত্যু ধরে রাখবে। শত ঝড়-তুফানেও সুপ্রিয়াকে ছাড়বে না। কেননা অভ্র বুঝে গেছে সুপ্রিয়াকে ছাড়া তার চলবে না। চলবে না মানে কিছুতেই চলবে না।
.
বেশ কিছুদিন হল সুপ্রিয়া ডিভোর্স চাচ্ছে অভ্রের কাছে। ওদের বিয়েটা হয়েছে মাত্র দেড় বছর। বিয়েটাও হয়েছিল পারিবারিক ভাবেই। আর এই দেড় বছরেই সুপ্রিয়ার মনোভাব পাল্টে গেছে। এখন আর তার অভ্রকে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না মানে একেবারেই ভালো লাগে না। অভ্র একটু বেশিই বাস্তববাদি, একরোখা একটা ছেলে।
অভ্রের নিজের কোন মেয়ে বান্ধবী নেই, সেটা কি সুপ্রিয়ার দোষ? সে চাইলেই বানাতে পারে। তাদের সাথে কথা বলতে পারে, ঘুরতে ফিরতে পারে। চাইলে বাসাই দাওয়াত করে এনে খাওয়াতেও পারে। এসবে সুপ্রিয়ার কোন আাপত্তি থাকত না।
অথচ সুপ্রিয়ার ছেলে বন্ধুদের ক্ষেত্রেই যত দোষ! বিয়ের আগে থেকেই সুপ্রিয়ার বেশকিছু ছেলে বন্ধু ছিল। বন্ধু মানে শুধুই বন্ধু এর বেশি কিছু না। শুধু যে ছেলে বন্ধুই ছিল বিষয়টা এমন না। অনেকগুলো মেয়ে বন্ধুও ছিল। সুপ্রিয়া বড় হয়েছে অন্যরকম একটা পরিবেশে। সেখানে ছেলে মেয়ের খুব বেশি বিভেদ নেই। অনায়াসে যে কেউ যে কারো সাথেই মিশে যেতে পারে, কথা বলতে পারে, হাসতে পারে। তার মানে এই না যে তাদের ভিতরে কিছু চলছে। অথচ অভ্র সুপ্রিয়ার ছেলে বন্ধুদের মেনে নিতে পারে না। তার এক কথা, সব গুলা ছেলে বন্ধুরে ছাড়তে হবে। যা কখনোই সুপ্রিয়ার কাছে সহজ ব্যাপার না। ওরা কি বলবে, কি ভাববে? বিয়ের পরে সুপ্রিয়া কত চেঞ্জ হয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর বাধ্যগত স্ত্রী ইত্যাদি ব্লা ব্লা!…
বিয়ের এই দেড়টা বছর শুধু এই একটা ব্যাপার নিয়েই ওদের ভিতরে যত ক্ষোভ, যত দ্বন্দ্ব আর রেষারেষি। অভ্র মেনে নিতে পারে না সুপ্রিয়ার ছেলে বন্ধুদের আর সুপ্রিয়া মেনে নিতে পারে না অভ্রের এমন মনোভাব, এমন দৃষ্টিকে।
অভ্র ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছে সুপ্রিয়ার ঠিক উল্টো একটা পরিবেশে। সেখানে ছেলে মেয়েদের ভিতরে বিভেদ ছিল, অবাধ মেলামেশা তো দূরে থাক সাধারণ বন্ধুত্ব বা দুই একটা কথা বলাকেও খুব বেশি ভালো চোখে দেখা হতো না। ছেলে আর মেয়ের ভিতরে কিসের এত বন্ধুত্ব কিসের এত মাখামাখি? বন্ধুত্ব করতে হবে কর সমস্যা নেই। কোন বাধাও নেই। তবে বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথেই কেন বন্ধুত্ব করতে হবে। হ্যা অল্প বিস্তর কথা যে হবে না বা থাকবে না তা নয়। তবে বেশি গভীরে গেলেই সমস্যা। আর বর্তমান সময়ের কথা কার অজানা? চারিদিকে অহরহ অঘটন ঘটছে এই ছেলে-মেয়ে বন্ধুত্ব নিয়ে। চোখের সামনের এত এত খবর আর নিউজ আমরা এড়িয়ে যাই কিভাবে? অভ্রের অবশ্য একটু বেশিই খোব। থাকার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে বটে। কেননা ওদের পাশের বাড়ির একটা মেয়ে তার এক ছেলে বন্ধুর বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে গিয়েছিল তার বাসাতে। পরেরদিন মেয়েটাকে করতে হয়েছিল আত্নহত্যা! অথচ, মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এবং সে নিজেও রাজি ছিল। আর তার কয়েকটা ছেলে বন্ধু ছিল। শুধুই বন্ধু আর কিছু না…
অভ্র খুব করে ভেবেছে। সুপ্রিয়াকে ছাড়া তার চলবে না। খুবই কষ্ট হবে। আবার সুপ্রিয়ার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরতে হলে সুপ্রিয়ার ছেলে বন্ধুদেরকে মেনে নিতে হবে। যেটা তার মন মানবে না। অনেক ভেবে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
- তুমি কি সত্যিই আমার থেকে মুক্তি চাও?
- হ্যা…
- ঠিক আছে। তোমাকে মুক্তি দেব। তার আগে একটা কাজ করতে হবে…
- বল কি কাজ?
- আমার সাথে একবার বৃষ্টিতে ভিজবে? শেষবারের মত, যেমনটা ভিজেছি বিয়ের পরে…
- ঠিক আছে…
ভাগ্য ভালো তখন বৃষ্টিরই দিন ছিলো। সুপ্রিয়াকে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। দু'দিন পরেই খুব করে বৃষ্টি হলো। ওরা দুজন একসাথে ভিজল। বিয়ের প্রথম দিকের মত করেই। অভ্র একেবারে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই করল। সুপ্রিয়াকে কোলে করে ছাদে নিয়ে গেল। বৃষ্টি হচ্ছে, দুজন মানুষ ভিজছে। একজন আরেকজনের দিকে পানি ছুড়ে মারছে, অভ্র কিছু কবিতা বলছে। ওর আবার কবিতা বলার সখ! হাসি হচ্ছে, গানও হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ওরা ভিজল। এর সব কিছুতেই সুপ্রিয়াও স্বাভাবিক ভাবে সাহায্য করল, যেন কিছুই হয়নি কিছুই হবে না। বরাবরের মতই অভ্র আবারো সুপ্রিয়াকে কোলে করে রুমে নিয়ে আসল। বিছানার উপরে বসিয়ে সুপ্রিয়ার ঠোঠের দিকে অভ্রের ঠোঠটা এগিয়ে নিয়ে গেল। সুপ্রিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে আগের মত এক্সাইটেড!
হঠাৎ অভ্র হেসে উঠল। হাসি যেন থামতেই চাইছে না! সুপ্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখ খুলে ফেলল। অভ্র বরাবরই এমন করে! সুপ্রিয়া নিজেই জোর করে অভ্রের মাথা ধরে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল অভ্রের মুখের দিকে। কিন্তু এবার আর পূর্বের মত হলো না। অভ্র এক ঝটকায় নিজেকে সড়িয়ে নিয়ে বলল,
- সবকিছু তৈরি করা আছে। তুমি আজ এই মূহুর্ত থেকে মুক্ত, ফ্রি! তুমি তোমার ইচ্ছামত চলতে পারো, উড়তে পারো…
সুপ্রিয়া কিছুক্ষণ তব্দা মেরে বসে থেকে স্বাভাবিক হলো। সে ভুলেই গিয়েছিল সবকিছু। সুপ্রিয়া চলে যাবার আগে অভ্র বলল,
- তুমি চাইলেই যে কোন সময় ফিরে আসতে পারো সুপ্রিয়া। আমার দড়জা তোমার জন্য আজীবন খোলা থাকবে। নিজের খেয়াল রেখ, আমাকে নিয়ে ভেবো না…
সুপ্রিয়া কিছু বলতে গিয়েও পারল না। সে চলে গেল আপন রাস্তায়।
-
বছর খানেক পরের ঘটনা। সুপ্রিয়া এখন সবসময়ই দোটানায় ভোগে। অভ্রকে ছেড়ে এসে ভুল করেছে কিনা। এই ব্যাপারটা নিয়ে। পরে ভাবে বিন্দাস চলছে জীবন। কারো কোন বাধা নিষেধ নেই, কারো নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস নেই।
এর ভিতরে আরেকটা ঘটনাও ঘটে গেছে। সুপ্রিয়া অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছিল। কিন্তু সে সন্তান নষ্ট করে ফেলেছে। অভ্রকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেও জানায় নি। সে আবার অভ্রের মুখোমুখি হতে চায় নি।
সেদিনও বৃষ্টির দিন ছিল। সুপ্রিয়া বাড়ি ফিরছিল ওর এক ছেলে বন্ধুর সাথে। সবশেষে এই একজনই টিকেছে যাকে একটু বেশিই ভরসা করা যায়! ছেলেটার নাম রাজ। সুপ্রিয়ার বেশ পুরাতন বন্ধু। একেবারে স্কুল লাইফের। হঠাৎ কি মনে করে সুপ্রিয়া ভিজতে শুরু করল। সাথে ভিজতে শুরু করল রাজ। বৃষ্টির দিন হওয়াতে চারিপাশে তেমন লোকও ছিল না। বৃষ্টিতে ভিজে সুপ্রিয়ার পরণের কাপড় ওর শরিরের সাথে লেপ্টে গেছে। রাজ কেমন কেমন চোখে তাকিয়ে আছে সুপ্রিয়ার দিকে! অথচ অভ্র কখনো এমন চোখে তাকায় নি। সুপ্রিয়ার ভয় করতে শুরু করল।
সুপ্রিয়ার ভয়টা সত্যি করল রাজ। সে ওর কাছাকাছি হয়ে একটা চুমু খেতে চাইল! সুপ্রিয়া রেগে কাপতে কাপতে রাজের গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। রাজ পিছন থেকে হাত টেনে ধরল। কেমন শক্ত হাত! কেমন চাহনি, কেমন এক কামুকতা ওর চেহারায়! রাজ বলল,
-শুধু একবারের জন্য আমার হ্ প্লিজ। আমি তোকে হতাশ করব না!
- তোর কি আমাকে বাজারের মেয়ে মনে হয়?
- তাহলে এতদিন আমার সাথে কেন বন্ধুত্ব রেখেছিস? আমি অনেকদিন হলো অপেক্ষায় ছিলাম। আমি তোকে চাই, খুব একান্তে নিজের করে চাই।
- ছি্ রাজ, তোর ঘরে বউ আছে…
- এখনকার সময়ে এগুলা কোন ব্যাপার?
রাজ কেমন নোংরা নোংরা কথা ছুড়ে দিচ্ছিল। সুপ্রিয়ার একটুও ভালো লাগল না। রাজ জোর করছিল। সুপ্রিয়া রাজের নিম্নদেশে একটা লাথি মেরে দৌড়ে কাদতে কাদতে বাড়ি ফিরল। অভ্র ঠিকই বলেছিল, ছেলে আর মেয়েতে বন্ধুত্বের ভিতরে এক অন্যরকম আকর্ষণ কাজ করে। ছেলে বন্ধু কখনো ভাই সমতুল্য হতে পারে না। সেটা সুযোগ দিলেই বোঝা যায়। সে এতদিন একটা ভুল, একটা মিথ্যা নিয়ে চলেছে।
**সমাপ্ত।
(পরিশিষ্ট: সুপ্রিয়া আবারো অভ্রের কাছে ফেরে। অনেকটা নির্লজ্জের মতো হয়েই ফেরে। সে ধরেই নিয়েছিল অভ্র তাকে গ্রহণ করবে না। সুপ্রিয়া ফিরেছিল শুধু নিজের ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চাইতে। যদিও সে ক্ষমার অযোগ্য!
অবাক হলেও সত্য, সুপ্রিয়াকে দেখেই অভ্র জড়িয়ে ধরল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,
- কি ঘটেছে, কি হয়েছে আমি তার কিচ্ছু শুনতে চাই না, কিছু জানতেও চাই না। আমার শুধু তোমাকে চাই, শুধুই তোমাকে…
সুপ্রিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে অভ্রের বুকে মুখ লুকালো। বৃষ্টিতে অভ্রের বুক ভিজে গেল। নোনা জলের বৃষ্টি!…)
:**: দ্যা লাষ্ট রেইন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন